মূল আরবীর বাংলা উচ্চারণ দেখে কুরআন পড়া বা তেলাওয়াত করা যাবে কি না? এর উত্তর নিয়ে আজকের এই লেখা।
সোজা কথায় এর উত্তর হলো: না। মূল আরবী কুরআন থেকে বাংলা উচ্চারণ দেখে পড়লে বা তেলাওয়াত করলে অবশ্যই আরবী মূল উচ্চারণ থেকে পার্থক্য হয়ে যাবে। আর এর ফলে অর্থের বিভিন্নতা সৃষ্টি হবে। আল্লাহ কুরআন এ যে কথা বলেছেন, সেটা না হয়ে অন্য অর্থ হয়ে যাবে। আর আল্লাহর আয়াত ভুল পড়লে- ভুল অর্থতে পরিণত করলে গুনাহ হবে।
নিচের দুটি ইউটিউব ভিডিও দেখতে পারেন। আরো ভালো করে বুঝার জন্যে। এর পর নিচে আরো reference দেওয়া হবে।
নিচে আরো বিভিন্ন রেফারেন্স দেওয়া হলো যেখানে কুরআন শুদ্ধ ,সুন্দর,সঠিক উচ্চারণ ও তারতীল এর সাথে পড়ার তাকীদ রয়েছে।
কোরআন মাজিদ আল্লাহ তা’আলার কালাম।
আল্লাহ তাআলা তা আরবিতে অবতীর্ণ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে,
নিশ্চয় আমি এটি অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় কুরআনরূপে, যাতে তোমরা বুঝতে পার।
[সূরা ইউসুফ: ২]
তাই আমাদের জন্য জরুরি হলো আরবিতেই কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করা। বাংলায় উচ্চারণ করা ঠিক নয়।
তাছাড়া আরবিতে এমন কিছু অক্ষর রয়েছে যেগুলোর প্রতিবর্ণ বাংলা ভাষায় নেই।
ফলে সে অক্ষরগুলো উচ্চারণ করার সময় ভুল উচ্চারণ করার কারণে আয়াতের অর্থ বিকৃত হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
সুতরাং উচিৎ হলো, আরবি ভাষা শিখে আরবিতেই কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করা।
আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, উপদেশ গ্রহণ করার কেউ আছে কি?
ক্বামার – ১৭
অথবা তার চেয়ে বাড়াও, আর ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে কুরআন পাঠ কর।
মুজ্জামিল-৪
(এ সূরাহ অবতীর্ণ হওয়ার সময় আল্লাহর রসূল তা মুখস্থ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লে আল্লাহ অভয় দিয়ে বললেন) কুরআন তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তুমি তোমার জিহবাকে দ্রুত আন্দোলিত করো না।
ক্কিয়ামাহ- ১৬
তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে কুরআন শিক্ষা করে । বুখারী
একবার আনাস রাদিআল্লাহুআনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কুরআন তিলাওয়াত কি রকম ছিল ? তিনি বলেন, টেনে টেনে পড়তেন, অতঃপর بسم الله الرحمن الرحيم তিলাওয়াত করেন। তিনি বিসমিলাতে মদ করেন, আর-রাহমানে মদ করেন ও আর-রাহিমে মদ করেন। (বুখারি : ৯:৯১, হা.৫,৪৬)
আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, হাফেজে কুরআনকে বলা হবে, পড় এবং ওপড়ে উঠ। তারতিলসহ পড় অর্থাৎ ধীরে ধীরে আবৃতি কর, যেমন দুনিয়াতে করতে। কারণ, সর্বশেষ আয়াতের স্থানই হবে তোমার মর্যাদার স্থান। (আবু দাউদ ২:৫৩, হা.১৪৬৪)
হজরত আলী (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমরা প্রত্যেকেই এমনভাবে কোরআন পড়, যেভাবে তোমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। -ফাজায়েলুল কোরআন, ইমাম ক্বাসেম ইবনে সাল্লাম: পৃ: ৩৬১
হজরত উসমান (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, হরজত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করে ও কোরআন শিক্ষা দেয়। -সুনানে আবু দাঊদ, হাদিস: ১৪৫২
হজরত আয়েশা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, যারা সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত করে, তারা নেককার সম্মানিত ফেরেশতাগণের সমতুল্য মর্যাদা পাবে এবং যারা কষ্ট সত্ত্বেও কোরআন সহিহ-শুদ্ধভাবে পড়ার চেষ্টা ও মেহনত চালিয়ে যায়; তাদের জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। -সুনানে আবু দাঊদ, হাদিস: ১৪৫৪
হজরত বারা ইবনে আযেব (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা সুললিত কন্ঠে কোরআন শরিফ পড়, কেননা তা কোরআনের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়। -শোয়াবুল ঈমান, হাদিস: ২১৪১
হজরত হুযাইফা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা কোরআনকে আরবি সুর ও লাহানে পড়, ফাসেক ও পাপাচারীদের সুরে পড়ো না। শীঘ্রই এমন এক দল বের হবে যারা গান ও বিরহের সুরে কোরআন পড়বে, অথচ তা তাদের গলা অতিক্রম করবে না, তারা খুবই রুগ্নআত্মা হবে। -আল মুজামুল আওসাত, তাবরানি, হাদিস: ৭২২৩
প্রত্যেক নর-নারীর ওপর কোরআনে কারিম এতটুকু সহিহ-শুদ্ধ করে পড়া ফরজে আইন যার দ্বারা অর্থ পরিবর্তন হয় না। অর্থ পরিবর্তন হয় এমন ভুল পড়ার দ্বারা নামাজ নষ্ট হয়ে যায়। অতএব কমপক্ষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য যে সূরাগুলোর প্রয়োজন, সেগুলোকে শুদ্ধ করে নেওয়া আবশ্যক, অন্যথায় সে গুনাহগার হবে। -মুকাদ্দামায়ে জাযারিয়া: পৃ: ১১
বর্তমানে অনেক লোককে দেখা যায়, তারা বাংলা উচ্চারণ দেখে কোরআন পাঠ করে থাকেন, অথচ আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় কোরআন পাকের সঠিক উচ্চারণ অসম্ভব, তাই কোরআন পাককে অন্য ভাষায় লেখা বা পড়া উলামায়ে কেরামের ঐক্যমতে নাজায়েয। এতে কোরআনের শব্দ ও অর্থ বিকৃত হয়ে যায়, যা সম্পূর্ণ হারাম। -আল ইতক্বান, পৃ: ৮৩০, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া: ১/৪৩
কোরআন আরবি লেখা দেখে পড়াই কর্তব্য। মুখস্থ পড়ার চেয়ে দেখে পড়ার সওয়াব দ্বিগুণ। একটি সওয়াব পড়ার, অপরটি কোরআনের হরফগুলো দেখার। বাংলা উচ্চারণ দেখে কোরআন পড়া কখনোই সহিহ হয়না। এতে অক্ষরের উচ্চারণ ভুল হয়ে কোরআনের অর্থ বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। এই জন্য আরবি শিখে কোরআন পড়া উচিৎ, নয়ত মুখস্থ করে সঠিক উচ্চারণে পড়া উচিৎ। বাংলা উচ্চারণ দেখে পড়লে সওয়াব হওয়ার চেয়ে গুনাহ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অপারকদের জন্য আরবি শেখার আগ পর্যন্ত অন্য উচ্চারণ পড়া বড়জোর জায়েজ হতে পারে। সওয়াবের আশা খুবই কম। আরবির সমান হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা। মোবাইল দেখে কোরআন পড়তে কোন সমস্যা নেই। ছাপা কোরআনের মতোই সওয়াব হবে।সূত্র: জামেউল ফাতাওয়া, ফতওয়া বিশ্বকোষ।উত্তর দিয়েছেন : মুফতি আল্লামা উবায়দুর রহমান খান নদভী।
অতএব কুরআন এর বাংলা অনুবাদ পড়ুন এবং বাংলা তে তাফসীর পড়ুন। কিন্তু আরবী থেকে বাংলা উচ্চারণ করে পড়া বা তেলাওয়াত করা থেকে বিরত থাকুন। আশা করি উপরের এই সকল লেখা পড়ার পর আপনারা বাংলা উচ্চারণে কুরআন শেখা বা পড়া থেকে বিরত থেকে ; কুরআন সহি শুদ্ধ ভাবে শেখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন এবং কুরআন তেলাওয়াত যত দ্রুত সম্ভব শেখার চেষ্টায় রত হবেন।
0 Comments